কথায় আছে, যুদ্ধ থেকে কেউই লাভবান হয় না। যুদ্ধের পরিণাম ক্ষতিই, ব্যতিক্রম ছাড়া। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানও কারো জন্য ভালো ফল বয়ে আনছে না। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে বিশ্বের অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতেই ব্যস্ত।
রাশিয়া যেন বিচ্ছিন্ন দেশ!
যেন সারা পৃথিবী এক হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে পৃথিবী থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া দেশ এখন রাশিয়া। আগে যেখানে উত্তর কোরিয়া এবং ইরানকে মনে করা হতো। রাশিয়ার ব্যাংক ঋণ দ্রুত বাড়ছে। সুদের হার দ্বিগুণ হয়েছে।
দ্য ইকোনোমিস্ট বলছে, যুদ্ধের আগে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এখন সেটা না হয়ে বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগামী বছর নাগাদ ৭ শতাংশ কমবে। অনেকের মতে, এই সংখ্যাটি ১৫ শতাংশ। ১৯৯৮ সালে রুশ শেয়ারবাজারে যখন ধস নেমেছিল তার চেয়েও বর্তমান পরিস্হিতি খারাপ। রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনই নিষেধাজ্ঞা না দিলেও ২০২৭ সালের মধ্যে নির্ভরতার অবসান ঘটানোর পরিকল্পনা করছে। অথচ রাশিয়ার অর্থনীতির মূল প্রভাবক এই জ্বালানি এবং ইইউই-এর প্রধান ক্রেতা।
অনেকের মনে হতে পারে, ইউক্রেন যুদ্ধে জয় পেলে রাশিয়ার অর্থনীতি আবার চাঙা হবে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ সত্য নাও হতে পারে। কারণ রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখল করে কিংবা পুতুল সরকার গঠন করে তাহলেও রাশিয়াকে অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই সেটা দেখা যায়। ১৯৯৯-২০০০ সালে চেচনিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া ৩০৮ কোটি ডলার ব্যয় করেছিল। এরপর সেখানে রাশিয়ার পুতুল সরকার ছিল মাত্র এক বছর। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করতে গিয়েও রাশিয়াকে প্রায় এ্কই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
ইউক্রেনের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি যা চেচনিয়ার চেয়ে ৪০ গুণ এবং ক্রিমিয়ার চেয়ে ২০ গুণ বড়। ইউরোপে রাশিয়ার পরেই আয়তনে ইউক্রেন বড় রাষ্ট্র। ফলে সেখানে ক্ষমতায় টিকে থাকতে মস্কোকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। ইউক্রেনকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং সেই অর্থ রাশিয়াকেই জোগান দিতে হবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক ক্ষতি হয়তো গোপনই থাকবে। কিন্তু দুই দিনের যুদ্ধে ইউক্রেন রাশিয়ার যে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়েছে তাতে অন্তত ৫০০ কোটি ডলারের বেশি হারাতে হয়েছে মস্কোকে।
রাশিয়াকে তার সৈন্যও হারাতে হচ্ছে। ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার ১২ হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়েছে। এটা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান অভিযানে নিহত হয়েছিল ১৫ হাজার সৈন্য। আর চেচেন যুদ্ধে নিহত হয়েছিল ৮ হাজার সৈন্য। রাশিয়ার মানুষের আয়ুষ্কাল এবং জিডিপির হিসাব করলে দেখা যায়, ১০ হাজার সৈন্য নিহত হলে রাশিয়ার ক্ষতি ৪০০ কোটি ডলার। এরপর বেঁচে থাকা সৈন্য ও তার পরিবারের মানসিক রোগ তো থাকবেই। পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাতে রুশ সামরিক বাহিনী পশ্চিমা বিশ্ব থেকে প্রযুক্তি আমদানি (ইলেক্ট্রনিকস এবং শিল্পে ব্যবহূত রোবট) করা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে কি না সেটাই দেখার বিষয়।
ইউক্রেন কতটা ক্ষতির মুখে?
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেনের প্রায় ৬০০ বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে এবং আহত সহস্রাধিক। ইউক্রেনের ২৫ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়েছে। আর দেশের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দাবি করেছেন, রাশিয়ার অভিযানে তাদের ১ হাজার ৩০০ সৈন্য নিহত হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ইগোর কোনাশেঙ্কভ বলেছেন, ইউক্রেনে এ পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজার সামরিক লক্ষ্যবস্ত্ত ধ্বংস করা হয়েছে। গত শুক্রবার তিনি জানান, ইউক্রেনের ৩ হাজার ৪৯১টি সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছ।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওলেগ উস্তেনকো গত ১০ মার্চ জানান, দেশটির অন্তত ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ-সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। ৫০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ। রাস্তাঘাট, সেতু, হাসপাতাল, নানা ধরনের সরঞ্জাম ও অন্যান্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন পরাজিত হলে ইউক্রেনের পুনর্গঠনে অর্থের সমস্যা হবে না বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। ইউক্রেনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অর্থ কোথা থেকে আসবে এমন প্রশ্নের জবাবে ওলেগ উস্তেনকো বলেন, আংশিক অর্থ আসতে পারে বিশ্বের বিভিন্ন স্হানে জব্দ হওয়া রাশিয়ার সম্পদ থেকে। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব প্রচুর পরিমাণে অর্থসহায়তা দিয়ে যাচ্ছে এবং পুনর্গঠনেও আরো অর্থ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
ক্ষতির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হা বলছে, ইউক্রেনে যুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্যের দাম ৮ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এটা স্পষ্ট নয় যে যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন এবার ফসল তুলতে পারবে কি না, তাছাড়া রুশ খাদ্য রপ্তানি নিয়েও উদ্বেগ আছে।
তাদের মতে, শীতকালীন শস্য, ভুট্টা এবং সূর্যমুখীর বীজের মতো ফসলের ২০-৩০ শতাংশ হয়তো এবার বপন করাই হবে না অথবা ফসল তোলা যাবে না। রাশিয়া হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গম রপ্তানিকারক, অন্যদিকে ইউক্রেন এক্ষেত্রে পঞ্চম বৃহত্তম। সব মিলিয়ে এ দুটি দেশ বিশ্বের যবের সরবরাহের ১৯ শতাংশ, গমের ১৪ শতাংশ এবং ভুট্টার ৪ শতাংশ জোগান দেয়। সংস্হাটি বলছে, ইউক্রেনে সংঘাতের কারণে পৃথিবীতে অপুষ্টিতে ভোগা লোকের সংখ্যা ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
বিশ্বব্যাংক গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত চলতে থাকলে নিম্ন আয়ের দেশগুলো খাদ্যঝুঁকিতে পড়বে। দেশগুলোর রেমিট্যান্সও কমে যাবে। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটও তৈরি হবে। কিছু উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ খাদ্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল।
ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশ তাদের আমদানি করা গমের ৭৫ শতাংশেরও বেশি নেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। দেশগুলো রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করতে পারছে না। খাদ্য পরিবহনও ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে খাদ্যের দাম বাড়তে পারে, এমনকি তৈরি হতে পারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাও।
রাশিয়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের বাজারেও একটি প্রধান শক্তি। এটি প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারের এক-চতুর্থাংশ, কয়লার বাজারের ১৮ শতাংশ, প্লাটিনামের বাজারের ১৪ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেলের বাজারে ১১ শতাংশ জোগান দেয়।
এই পণ্যগুলোর সরবরাহে বিরাট প্রভাব পড়েছে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও কমিয়ে দেবে। বিশ্বব্যাংকের অনুমান, তেলের দাম ১০ শতাংশ বেড়েছে। এসব চলতে থাকলে পণ্য-আমদানিকারী উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে প্রবৃদ্ধি হতাশাজনকভাবে কমবে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত স্হায়ী হলে চীন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তুরস্কের মতো তেল আমদানিকারক দেশগুলোতেও প্রবৃদ্ধি কমবে। মধ্য এশিয়ার অনেক দেশে সংঘাতের ফলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
লাভবান হবে কারা?
প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো দাবি করেছেন, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা তাদের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াবে। তবে টাইম ম্যাগাজিন জানায়, রুশ মুদ্রা রুবলের পতনে মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়বে। ইতিমধ্যে ডলারের দাম ৩ শতাংশ বেড়েছে। ইউরোপের পাউন্ড কিছুটা লাভবান হবে।
আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের সিনিয়র ফ্যাকাল্টি ফেলো রবার্ট রাইট বলছেন, মেক্সিকো এবং তুরস্ক লাভবান হতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে যেগুলো আমদানি করা যাবে না, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আমদানি করা হবে। ফলে নিষেধাজ্ঞার কবলে না থাকলে ঐ দেশগুলোর বাণিজ্য বাড়বে। আবার ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে মেধাবী এবং দক্ষ কর্মীরা বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা পালিয়ে অন্য দেশে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ লাভবান হবে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে লাভবান হয়েছে।